৫+ বয়স থেকে ১১+ বয়স পর্যন্ত শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা স্তর। এ স্তরে শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। এ স্তরে শিশুরা অবাধ বিচরণের মাধ্যমে, খেলাধুলার মাধ্যমে, মুক্ত পরিবেশে ও প্রকৃতিকে চেনার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করে। আমাদের দেশের প্রাথমিক স্তরের শিশুরা নানা কারণে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগ পায়না। এর মধ্যে একটি কারণ হচ্ছে শিশুর দৈহিক ও মানসিকতার পরিপন্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি। প্রাথমিক স্তরের শিশুরা বিদ্যালয়ে সকাল ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪ পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। এতো দীর্ঘ সময় খাঁচার মধ্যে বন্দি থাকার মতো অবস্থায় ধরা বাঁধা নিয়মের মধ্যে থেকে কিভাবে শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাথমিক স্তরের অধিকাংশ শিশুই দু’বেলা দু’মুঠো পুষ্টিকর খাবার ঠিকমত পায়না অথচ সে সকল শিশুদেরকেই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কখনও অনাহারে কখনও বা অর্ধাহারে অথবা পান্তা ভাত খেয়ে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসতে হয়। বিদ্যালয় শেষে বাড়ি ফিরতে সময় লাগে প্রায় সন্ধ্যা (বিশেষ করে শীতকালে)। এতো দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে অবস্থান করা শিশুদের পক্ষে যেমন অত্যন্ত কষ্টকর তেমনি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্তরায়।
আরও পড়ুনঃ এসএসসির ফল ৬ মে’র মধ্যে
শিশু মনোবিজ্ঞানের ভাষায়-‘খেলার ছলে শিক্ষা শিক্ষা নীতির দীক্ষা’। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের খেলাধূলা করা তো দূরের কথা, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, খাওয়া-দাওয়া ও ঘুমানোর সময় পর্যন্তও তারা ঠিক মতো পায় না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেড়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত মাত্র ৩০ মিনিট বিরতি থাকে। এ সময় টিফিন খেতে গেলে খেলাধূলার সময় পাওয়া যায়না আবার খেলাধূলা করতে গেলে টিফিন খাওয়া হয় না। মোটকথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচিতে একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। শিশু মনোবিজ্ঞানীদের মতে শিশুদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে ১৫+ বয়স পর্যন্ত, যা খেলাধূলা ও মুক্ত পরিবেশে বিচরণের মাধ্যমেই সম্ভব।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচির কারণে বিদ্যালয়গামী কোমলমতি ও অবুঝ শিশুরা খেলাধূলা ও মুক্তভাবে বিচরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা মোটেই কাম্য নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয় প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা। অপরদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হয় মাত্র ছয় ঘন্টা। কলেজের শিক্ষার্থীদের তো ধরা বাঁধা তেমন কোন নিয়ম মেনে চলতে হয়না। অনেক কলেজে তো বিকাল ৩টার মধ্যে ক্লাস শেষ হয়ে যায়। যাদের ধারণ ক্ষমতা কম সেই অবুঝ শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হবে দীর্ঘ সময়! আবার যাদের ধারণ ক্ষমতা বেশি তাদেরকে বিদ্যালয়ে অবস্থান করতে হবে কম সময়-এটা আবার কোন বিবেকে, কেমন করে? আসলে আমাদের বিদ্যালয়ের সময়সূচিতে ব্যাপক অসঙ্গতি রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে সকাল ৯টার পূর্বে অবশ্যই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু এ সময়ে এসব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারে না। এ নির্ধারিত সময়ে সিংহভাগ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকে। ফলে শিক্ষকগণ নির্ধারিত সময় পাঠদান শুরু করতে পারেন না। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে দেরিতে উপস্থিতির কারণ হচ্ছে-বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এখানকার শিশুরা ঘুম থেকে উঠে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মক্তবে চলে যায়।
আরও পড়ুনঃ আবারোও প্রাথমিকে নিয়োগ হচ্ছে পুল শিক্ষক
মক্তব থেকে বাড়ি ফেরে গোসল-খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিদ্যালয়ে যেতে দেরি হয়ে যায়। আর এরূপ দেরি হওয়া তো স্বাভাবিক। এভাবে নানাবিধ কারণে প্রাথমিক স্তরে মানসম্মত পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে। উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষাদান চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নদী বেষ্টিত অঞ্চলে শিক্ষকগণ তো সময়মত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারেন না সেই সাথে শিক্ষার্থীরাও সময়মত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে পারে না। এমতাবস্থায় প্রচলিত সময়সূচিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কিভাবে সুষ্ঠু পাঠদান সুনিশ্চিত হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
প্রাথমিক শিক্ষার দীপ্তি-উন্নত জীবনের ভিত্তি। সেই প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে শিশুর শারীরিক ও মানসিকতার সাথে সঙ্গতি রেখে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচির প্রণয়ন করা অতি প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, শিশুদেরকে দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে চাপের মধ্যে রেখে কোন ধরণের বিকাশ সম্ভব হবে না। সূত্রঃ বাংলাদেশ জার্নাল।